খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলী গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের সুপারিশে বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী স্যার আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র রায়ের (পিসি) পিতার হাতে গড়া দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টি দীর্ঘ ১৭০ বছরে জাতীয়করণ হয়নি। অবিভক্ত বাংলার বিশ্ব বরেণ্য ব্যক্তিদের এই বিদ্যালয়ে পর্দাপন ঘটলেও জাতীয়করণ না হওয়ায় হতাশা বিরাজ করছে সর্বস্তরে।
সুত্রে প্রকাশ, খুলনা জেলার পাইকগাছা উপজেলার রাড়ুলী গ্রামে ১৮৬১ সালের ২ আগস্ট হরিশ্চন্দ্র রায়ের ঘরে জন্মগ্রহণ করেছিলেন বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী স্যার আচার্য প্রফুলø চন্দ্র (পিসি) রায়। তাঁর জন্মের ১১ বছর আগে অর্থাৎ ১৮৫০ সালে তাঁর বাবা হরিশ্চন্দ্র রায় তার স্ত্রী’র নামে ভূবন মোহিনী বালিকা বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন।
স্থানীয়দের দাবী এটি বাংলাদেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ১৭০ বছরেও ঐতিহ্যবাহী এ বিদ্যাপীঠে একটি বহুতল ভবনের কাজ নির্মানাধীন থাকলেও মূল ভবনে কোন উন্নয়নের ছোঁয়া লাগেনি। বর্তমানে দেশে একের পর এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলেও সে তালিকায় দেশের সর্ব প্রথম প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়টি স্থান পায়নি।
বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও স্থানীয়দের দেওয়া তথ্য মতে, ১৮৫০ সালের পূর্বে কোন এক সময় পাইকগাছার রাড়ুলী গ্রামে বেড়াতে আসেন জ্ঞানের ভান্ডার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তিনি আচার্য্য পিসি রায়ের পিতা হরিশ্চন্দ্রকে নারী শিক্ষার উন্নয়নে একটি আলাদা নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য সুপারিশ করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের সুপারিশ অনুসারে হরিশ্চন্দ্র রায় তার স্ত্রী’র নামে রাড়ুলী গ্রামে ভূবন মোহিনী বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন এবং স্ত্রী’কে ঐ বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী হিসেবে ভর্তি করেন। এটি বাংলাদেশের ও ভারতীয় উপমহাদেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে ১৬ জন শিক্ষক ও তিনজন কর্মচারী রয়েছেন। ছাত্রী আছে তিন শতাধিক। এ বিদ্যালয় থেকে ২০১৯ সালে ৪৫ জন ছাত্রী মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নিয় শতভাগ পাশ করে। দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টি ১৭০ বছর নারী শিক্ষার উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষক কর্মচারীদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। স্বাধীনতার পর দেশের শত শত নারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হলেও দেশের প্রথম প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়টি আজও অবহেলিত, সুবিধা বঞ্চিত। একটি নতুন ভবন নির্মাণাধীন থাকলেও মূল ভবন রয়েছে জরাজীর্ণ। ১৯৩৮ সালের ২০ এপ্রিল তৎকালীন শিক্ষা মন্ত্রী দেশের প্রথম প্রতিষ্ঠিত বালিকা বিদ্যালয়ের নাম শুনেই ছুটে আসেন রাড়ুলী গ্রামে। বিদ্যালয়টিতে পর্দাপন করে পরিদর্শন বইতে লিখিত মন্তব্যে ‘এগিয়ে যাওয়ার আশ্বাস দেন বিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও এলাকাবাসীর’। পাঁচ বছর পর ১৯৪৩ সালের ২৬ এপ্রিল একই সংবাদ শুনে ছুটে আসেন অবিভক্ত ভারতের ইতিহাসখ্যাত মেঘনাদ সাহা সহ চার জন প্রতিনিধি দল। নারী শিক্ষা বিস্তারের জন্য বাংলার প্রথম বালিকা বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জন্য পিসি রায়ের পিতাকে ধন্যবাদ জানিয়ে পরিদর্শণ বইতে তাদের মূল্যবান মতামত তুলে ধরেন। আরও যে তিন জন বরেণ্য ব্যক্তি প্রতিনিধি দলে ছিলেন তারা হলেন প্রফুল্ল চন্দ্র মিত্র, বীরেন চন্দ্র গুহ ও বীরেন্দ্রনাথ মজুমদার। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৮৬ সালের ১০ জুলাই বিদ্যালয়টি পরিদর্শণ করেন অধ্যাপক কে.আলী, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পিএইচডি প্রাপ্ত ইফতেখার হোসেন। ১৯৯২ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর নায়েমের মহাপরিচালক, ১৯৯৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মোঃ ফজলুর রহমান। ২০০২ সালের ১১ ফেব্রয়ারি সাবেক ইউএনও বর্তমান প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ডঃ এ এফ এম মনজুর কাদির। প্রত্যেক বরেণ্য ব্যক্তিরা পরিদর্শণ শেষে লিখিত মন্তব্যে “নারী শিক্ষার অগ্রযাত্রায় বিদ্যালয়ের ভবিষ্যৎ কামনা করেছন”। তাদের মূল্যবান মন্তব্য শুধূ পরিদর্শন খাতায় লিপিবদ্ধ থেকে গেছে, অজ পাড়া গায়ে প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় কর্মস্থলে ফিরে কেউ মনে রাখেননি। সরকারী ভাবে বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানী আচার্য প্রফুল্ল চন্দ্র (পিসি) রায়ের জন্ম ও মৃত্যু বার্ষিকী পালনকালে সেখানে উপস্থিত সরকারের উচচ মহলের কর্মকর্তাদের নিকট দাবী পেশ করে আসছেন। শিক্ষক- শিক্ষার্থীরা কান্না বিজড়িত কণ্ঠে প্রশ্ন তোলেন কবে তাদের প্রিয় বিদ্যাপীট জাতীয়করণ হবে ? সর্বশেষ ২০১৯ সালের ২ আগষ্ট পিসি রায়ের জন্ম দিবসে খুলনা জেলা প্রশাসক, স্থানীয় এমপি, উপজেলা নির্বাহী অফিসার সহ সরকারী উচচ পর্যায়ের কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে অত্র বিদ্যালয়ের দশম শ্রেণির ছাত্রী লাবিবা হাসনাত তার বক্তব্যে বলে, ‘দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়ে লেখাপড়া করতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করি। কিন্তু যখন অবহেলিত বিদ্যালয়ের করুণ চিত্র দেখি তখন খুব কষ্ট হয়। যে প্রতিষ্ঠান ১৭০ বছর ধরে নারী শিক্ষার উন্নয়নে অবদান রেখে আসছে, তার খবর কেউ রাখেন না।’ একই আক্ষেপ বিদ্যালয়টির নবম শ্রেণির ছাত্রী ডরথী দাশ ও দশম শ্রেণির অন্তরা খাতুন সহ সকল শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক গৌতম কুমার ঘোষ বলেন ‘১৮৫০ সালে একজন বরেণ্য ব্যক্তির প্রতিষ্ঠিত ও বিশ্ববরেণ্য বিজ্ঞানীর মায়ের নামে হওয়া দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয় আজও অবহেলিত, উন্নয়ন বঞ্চিত।
বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি ও রাড়ুলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুল মজিদ গোলদার বলেন, ‘জাতীয়করণ না করায় দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার ইতিহাস ও ঐতিহ্য মুছে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে একাধিকবার জেলা পরিষদ প্রশাসক, স্থানীয় সংসদ সদস্যদের (ইতিপূর্বে পর্যায়ক্রমে) জানিয়েছি। ছাত্রী শিক্ষকদের আক্ষেপঘন বক্তব্য শুনে বর্তমান সংসদ সদস্য আলহাজ্ব মোঃ আক্তারুজ্জামান বাবু বলেন, দেশের প্রথম বালিকা বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের বিষয়ে অচিরেই সংশ্লিষ্ঠ দপ্তরে সুপারিশ পাঠাবো এবং প্রয়োজনে তিনি শিক্ষা বান্ধব প্রধানমন্ত্রীর স্মরনাপন্ন হবেন।