আজ || শুক্রবার, ১৮ অক্টোবর ২০২৪
শিরোনাম :
  সাবেক ছাত্রলীগ ক্যাডার দুর্নীতিবাজ সাইফুলকে জেলা প্রশাসক পদ থেকে প্রত্যাহারের দাবি       টানা তিন জয়ে শ্রীলঙ্কাকে সিরিজ হারাল বাংলাদেশ       মৃত দাদির জন্য খাটিয়া বহনকালে ট্রাকের ধাক্কা, নাতিসহ নিহত ৩       বিএসএফের গুলিতে নিহত জয়ন্তর মরদেহ ফেরত       গুলিতে নিহত বাংলাদেশি যুবকের মরদেহ ফেরত দিলো বিএসএফ       পরিকল্পনা বদলে শেখ হাসিনা ও তার পরিবারকে ৬টি প্লট দেয় রাজউক       পেট্রোবাংলায় তিতাসের কর্মীদের হামলা-ভাঙচুর       সরকারি বঙ্গবন্ধু কলেজে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে শহীদদের স্মরণে আলোচনা সভা ও দোয়া অনুষ্ঠিত       ফকিরহাটে পিকআপ-ইজিবাইকের মুখোমুখি সংঘর্ষে নিহত ৪       ঠাকুরগাঁওয়ে বিএসএফের গুলিতে জয়ন্ত কুমার নামে বাংলাদেশির মৃত্যু    
 


প্রাথমিক শিক্ষা ও শিক্ষক প্রশিক্ষণ

দেবাশিস বসু, ইন্সট্রাক্টর (সাধারণ), সাতক্ষীরা পিটিআই


শিক্ষাই জাতির মেরুদন্ড, শিক্ষা ছাড়া কোন জাতি উন্নতি করতে পারে না- এমন বাক্য আমরা বুঝে বা না বুঝেই মুখস্থ করে এসেছি এবং এগুলো অতিশয় সত্য বাণীও বটে। এই মেরুদন্ড যে কারখানায় তৈরি হয়, তার নাম প্রাথমিক বিদ্যালয়। একটি শিশু ভবিষ্যতে কতটুকু ন্যায় নীতিবান হবে, আদর্শবান, চরিত্রবান হবে কিংবা দেশ, জাতি, সমাজের প্রতি কতটুকু দায়িত্বশীল হবে, এটি অনেকাংশেই নির্ভর করে তার প্রাথমিক জীবনের শিক্ষার উপর। প্রাথমিক শিক্ষার গুরুত্ব তাই অপরিসীম।
দেশের প্রাথমিক শিক্ষায় গত কয়েক বছরে বেশ অগ্রগতি হয়েছে। এর শুরুটা হয়েছিল জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এঁর হাত ধরেই। ১৯৭৩ সালে ৩৬ হাজার ১৬৫টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করে প্রাথমিক শিক্ষার অগ্রযাত্রার শুভ সূচনা করেছিলেন তিনি। এরই ধারাবাহিকতায় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১৩ সালে প্রায় ২৬ হাজার বেসরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়কে জাতীয়করণ করেন। প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নে সরকারের গৃহীত আরও পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে চার দফার প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি। এসব কর্মসূচিতে শিক্ষার্থীদের হাতে বছরের প্রথম দিনেই ‘বই উৎসব’ এর মাধ্যমে নতুন রঙিন বই তুলে দেওয়া, উপবৃত্তি কার্যক্রম, অনগ্রসর এলাকায় স্কুল ফিডিং চালু, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে চুক্তিভিত্তিক দপ্তরী কাম নৈশ প্রহরী নিয়োগ, স্টুডেন্ট কাউন্সিল গঠন প্রভৃতি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। শিশুদের মানসিক বিকাশ ও খেলাধুলার প্রতি আকৃষ্ট করতে শিক্ষার্থীদের জন্য ‘বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপ ফুটবল টুর্নামেন্ট’ এবং ‘বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব গোল্ডকাপ প্রাথমিক বিদ্যালয় ফুটবল টুর্নামেন্ট’সহ ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতার আয়োজন করা হচ্ছে। শিক্ষকের নতুন পদ সৃষ্টিসহ প্রায় ৮০ হাজার শিক্ষক নিয়োগ, প্রাক-প্রাথমিক শ্রেণি চালুসহ বেশ কিছু উদ্যোগ প্রশংসনীয়। বিদ্যালয় পর্যায়ে ডিজিটালাইজেশন প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে। ল্যাপটপ প্রদান, ডিজিটাল হাজিরা মেশিন স্থাপন, মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর, ওয়াই-ফাই রাউটার প্রদানসহ নানাবিধ সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত হয়েছে প্রান্তিক পর্যায়ে। গমনোপযোগী প্রায় শতভাগ শিশুকে বিদ্যালয়ে ভর্তি, ছাত্র-ছাত্রীদেও মাঝে সমতা আনয়ন, নতুন শিক্ষাক্রমে নতুন পাঠ্যবই, অবকাঠামো উন্নয়নসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে উন্নয়ন চলমান।
সময় পাল্টাচ্ছে। শিক্ষার প্রসারের সাথে এখন গুণগতমানকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বাস্তবিকভাবেই গুণগত ও মানসম্মত শিক্ষা এখন অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। শিশুদের কচি মনে প্রকৃত শিক্ষার বীজটা বপন করে দিতে হবে। এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ হলো শিক্ষার প্রারম্ভিক পর্যায়। সন্দেহ নেই, প্রাথমিক শিক্ষাই হচ্ছে সব শিক্ষার মূল ভিত্তি।
প্রাথমিক শিক্ষাকে শক্ত করে দাঁড় করাতে যারা নিরলস পরিশ্রম করেন, তারা আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক। এসব শিক্ষকদের পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নও তাই প্রাথমিক শিক্ষার উন্নয়নের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পেশাগত দক্ষতা বাড়াতে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের কোন বিকল্প নেই। চলমান পদ্ধতিতে প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে যে ধরণের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়ে থাকে, তা আরও আধুনিকায়ন করা আবশ্যক। প্রশিক্ষণার্থী শিক্ষকদের তাত্ত্বিকজ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবহারিক ও বাস্তবতার নিরিখে চাহিদাভিত্তিক কাজগুলো সমন্বয় করতে হবে। হাতে-কলমে প্রশিক্ষণের সময় বাড়াতে হবে। ২০১২ সাল থেকে ডিপিএড কর্মসূচি শুরু হওয়ায় শিক্ষার্থী শিক্ষকগণ তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি হাতে-কলমে শিখন শেখানো কাজে অংশ নিয়ে অভিজ্ঞ হতে পারছেন। ইউনেস্কোর এশিয়া প্যাসেফিক রিজিওনাল ব্যুরো ফর এজুকেশন এ বাংলাদেশের প্রাথমিক শিক্ষার মান নিয়ে এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, যোগ্যতাসম্পন্ন শিক্ষকের অভাবেই শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। প্রাথমিক শিক্ষক প্রশিক্ষণে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। বাংলাদেশে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পাশাপাশি আরও বিভিন্ন ধরণের বিদ্যালয় রয়েছে যেখানে প্রাথমিক স্তরের পাঠদান হয়। এসব বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষকের মধ্যে প্রায় ৬৪ শতাইশ নারী। অবকাঠামো, নারীবান্ধব কর্মস্থল ইত্যাদি নানা প্রতিকূলতা রয়েছে। শিক্ষক প্রশিক্ষণসহ এসব বিভিন্ন ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জ অতিক্রম করে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে।
শিক্ষক প্রশিক্ষণ এবং মানসম্মত প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করতে সরকার বদ্ধপরিকর। ইতোমধ্যে শিক্ষক প্রশিক্ষণ যুগের সাথে তাল মিলিয়ে আপডটে করা হয়েছে। ২০১২ সালের জুলাই মাসে দেশের ৭টি পিটিআইতে ডিপিএড কোর্স শুরু হয়। ১৯৭৯ সালে শুরু হওয়া সি-ইন এড কোর্সটি ১৯৯২ এবং ২০০১ সালে পরিমার্জিত হয়, যা এক বছর মেয়াদী প্রশিক্ষণ ছিল। বর্তমান ডিপিএড কোর্স ১৮ মাস মেয়াদী যা ৪টি পৃথম টার্মে বিভক্ত। প্রথম ৩টি টার্মে প্রশিক্ষনার্থীগণ সরাসরি পিটিআই প্রশিক্ষকগণের অধীনে হাতে-কলমে ধারণা বিনিময় করেন এবং ৪র্থ টার্মে নিজ বিদ্যালয়ে ইর্ন্টানশীপ সম্পন্ন করেন। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয় বিভিন্ন সুপারিশের ভিত্তিতে একটি জাতীয় পর্যায়ের কমিটি গঠন করে। এই কমিটির তত্ত্বাবধানে ৪জন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরামর্শক কোর্সটির রূপরেখা প্রণয়ন করেন। পেশাগত জ্ঞান ও উপলব্ধি, পেশাগত অনুশীলন এবং পেশাগত মূল্যবোধ ও সম্পর্ক স্থাপন- এই তিনটি উদ্দেশ্য নিয়ে বিশ^মানের এই কোর্সটি চালু করা হয়। ২০১২ সালে জুলাই মাস থেকে শুরু হলেও ২০১৫ শিক্ষাবর্ষ থেকে জুলাই মাসের পরিবর্তে জানুয়ারি মাস থেকে কোর্সটির শিক্ষাবর্ষ শুরু হয়। ১ ক্রেডিট ঘন্টা সমান ১৫ ঘন্টা ধরে কোর্সটি ৯৬ ক্রেডিট ঘন্টায় হিসাব করা হয় যার মধ্যে পিটিআইতে ৪৭.৫ ক্রেডিট ঘন্টা এবং বিদ্যালয়ে ৪৮.৫ ক্রেডিট ঘন্টা সময় পার করেন প্রশিক্ষনার্থীরা। ২০ সপ্তাহ তাত্ত্বিক শিক্ষাদান ও ১৬ সপ্তাহ অনুশীলনে মধ্যে দিয়ে একজন নতুন শিক্ষক অভিজ্ঞ হয়ে উঠেন। ডিপিএড প্রোগ্রামে ১২টি বিষয়ভিত্তিক কোর্স আছে যার মধ্যে ৬টি বিষয়জ্ঞান সম্পর্কিত, ৫টি শিক্ষণ বিজ্ঞান সম্পর্কিত এবং ১টি পেশাগত শিক্ষা কোর্স। সমগ্র কোর্সের জন্য রয়েছে ২৯টি তথ্যপুস্তক বা সামগ্রী।
প্রশিক্ষনার্থী শিক্ষকদের মূল্যায়নে রয়েছে ২৩টি শিক্ষকমান এবং ৩৭টি শিক্ষক যোগ্যাতা। বিভিন্ন ইন্ডিকেটর এর মাধ্যমে প্রশিক্ষনার্থীরা এই যোগ্যতাসমূহ অর্জন করেন। উন্নত বিশে^ শিক্ষক শিক্ষার দার্শনিক ভিত্তি ‘গঠনবাদ তত্ত্ব’ অনুসরণ করে এই কোর্সটির ভিত্তি রচিত হয়েছে। সে অনুসারে কোর্সটির শিক্ষাক্রম, প্রোগ্রাম কাঠামো ও মূল্যায়নের ক্ষেত্রে গঠনবাদ তত্ত্ব অনুসরণ করা হয়েছে। অ্যাকশন রিসার্চ, অ্যাসাইনমেন্ট, লিখিত পরীক্ষা, লেসন স্ট্যাডি, ব্যবহারিক কাজ, আইসিটি জ্ঞান সহ বেশকিছু লক্ষ্যনীয় দিক রয়েছে শিক্ষক প্রশিক্ষণের এই কোর্সটিতে। মোট ১২শ নম্বরের মধ্যে গাঠনিক ও চূড়ান্ত মূল্যায়ন করা হয়। এছাড়া রয়েছে ১০০ নম্বরের শিক্ষকমান মূল্যায়ন। ফলাফল প্রদান করা হয় গ্রেডিং পদ্ধতিতে।
শিক্ষক প্রশিক্ষণকে আধুনিকায়ন এবং প্রাথমিক শিক্ষায় সর্বোচ্চ সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করে প্রাথমিক শিক্ষার মানোন্নয়নে সরকারের পাশাপাশি স্থানীয় স্টেকহোল্ডারদেরও স্বস্ত:স্ফূর্ত ভূমিকা রাখতে হবে। শিশুকে সুনাগরিক হিসেবে গড়ে তুলতে প্রতিটি নাগরিকই যার যার অবস্থান থেকে ইতিবাচক ভূমিকা রাখবেন- প্রত্যাশা এটাই।

দেবাশিস বসু, ইন্সট্রাক্টর (সাধারণ), সাতক্ষীরা পিটিআই


Top