ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছাড়ার পর তার বিরুদ্ধে একের পর এক মামলা দায়ের হচ্ছে। এরই ধারাবাহিকতায় ঢাকায় শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আরো একটি হত্যা মামলা দায়ের হয়েছে। রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় আন্দোলনকালীন গুলিতে নিহত শিক্ষার্থী নাঈম হাওলাদারের (১৭) বাবা মোঃ কামরুল ইসলাম বাদী হয়ে এ মামলা করেছেন।
মামলায় শেখ হাসিনা ছাড়াও একাধিক মন্ত্রী-এমপি, আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, পুলিশ ও র্যাব কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। মামলার এজাহারে ১৯৩ জনের নাম উলেখ এবং ৩০০ জনকে অজ্ঞাত পরিচয় আসামি হিসেবে দেখানো হয়েছে।
অন্য আসামিরা হলেন : সজীব ওয়াজেদ জয়, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল, সাবেক এমপি শেখ হেলাল, সাবেক এমপি শেখ সারহান নাসের তন্ময়, সাবেক মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, হাসানুল হক ইনু, রাশেদ খান মেনন, আমির হোসেন আমু, তাজুল ইসলাম, আনিসুল হক, ডাঃ দীপু মনি, মোহাম্মদ এ আরাফাত, শ ম রেজাউল করিম, মহিউদ্দিন খান আলমগীর, আসাদুজ্জামান খান কামাল, আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম, ড. হাসান মাহমুদ, শাহজাহান খান, মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল, জুনাইদ আহমেদ পলক প্রমুখ।
আসামিদের তালিকায় আরো আছেন : ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের সাবেক মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস, উত্তর সিটির সাবেক মেয়র আতিকুল ইসলাম ও সাবেক এমপি হাজী মোহাম্মদ সেলিম।
যেসব পুলিশ কর্মকর্তা আসামি : ডিএমপির ওয়ারী বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ইকবাল হোসাইন, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুলাহ আল-মামুন, সাবেক এসবি প্রধান মনিরুল ইসলাম, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ, যুগ্ম-পুলিশ কমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার, যুগ্ম-কমিশনার এস এম মেহেদী হাসান, লালবাগ থানার ওসি-অপারেশন আতিকুল হক, লালবাগ জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার মোঃ নজরুল ইসলাম, শাহবাগ থানার উপ-পরিদর্শক আশরাফুল সিকদার ও ডিবির কয়েকজন কর্মকর্তা।
যেসব সাংবাদিককে আসামি : একাত্তর টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু, একাত্তর টিভির সাবেক বার্তা প্রধান সৈয়দ ইশতিয়াক রেজা, এটিএন নিউজের সাবেক বার্তা প্রধান মুন্নী সাহা, একাত্তর টিভির প্রিন্সিপাল করেসপন্ডেন্ট ফারজানা রুপা, একাত্তর টিভির চাকরিচ্যুত হেড অব নিউজ শাকিল আহমেদ ও সাবেক প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব নাইমুল ইসলাম খান।
এছাড়াও ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি বদিউজ্জামান সোহাগ, সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাকির হোসেন, সাবেক সাধারণ সম্পাদক সিদ্দিকী নাজমুল আলম, যুবলীগের চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ, যুবলীগের সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসান খান নিখিল, সাবেক এমপি ও চিত্রনায়ক ফেরদৌস আহমেদ ও ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবিরকে আসামি করা হয়েছে।
মামলার বাদী নিহত নাঈম হাওলাদারের বাবা কামরুল ইসলাম এজাহারে উলেখ করেছেন, দেশব্যাপী বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ১৪ দলের নেতা-কর্মীদের সরাসরি নির্দেশে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণে পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির কিছু উচ্ছৃঙ্খল, অসাধু, সুবিধাভোগী ও অতি উৎসাহী কর্মকর্তা ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচারে গুলি চালায়। এতে সহস্রাধিক মানুষ নিহত এবং অগণিত মানুষ আহত ও পঙ্গুত্ববরণ করেন।
মামলার বাদী আরো বলেন, আমার ছেলে নাঈম হাওলাদার একাদশ শ্রেণির একজন মেধাবী শিক্ষার্থী। গত ১৯ জুলাই বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্র ও সাধারণ জনতার সঙ্গে যাত্রাবাড়ী এলাকায় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যুক্ত হয়। তখন শেখ হাসিনার নির্দেশে নিরীহ ছাত্র-জনতার ওপর আসামিরা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে নিরীহ ছাত্রদের ওপর উপর্যুপরি এলোপাতাড়ি গুলি চালায়। তারা পেট্রোল বোমা, ককটেল বিস্ফোরণ, হাত বোমা ও রাবার বুলেট নিক্ষেপ করে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে ছাত্র-জনতাকে কোপাতে থাকে।
এজাহারে বাদী বলেন, এ সময় আমার ছেলে নাঈম হাওলাদার বাম কাঁধের সামনের দিকে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় পড়ে যায়। পরে দুপুর ২টার দিকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় ভর্তি করানো হয়। বিকেল ৩টা ১২ মিনিটের দিকে নাঈম মারা যায়।
বগুড়া : ২০১৮ সালে শিবগঞ্জ বিএনপি’র নেতা শাহ আলম সুজাকে হত্যার অভিযোগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তার ছোট বোন শেখ রেহানা, ছেলে সজীব ওয়াজেদ জয়, মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ (পুতুল), শেখ রেহানার ছেলে রেদোয়ান মুজিব সিদ্দিকীকে আসামি করে বগুড়ায় আরেকটি হত্যা মামলা হয়েছে।
জেলা আদালতের আইনজীবী ও শিবগঞ্জ উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক আবদুল ওহাব বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার বিকেলে বগুড়ার অতিরিক্ত চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট সুকান্ত সাহার আদালতে মামলাটি দায়ের করেছেন। আদালত মামলাটি আমলে নিয়ে শিবগঞ্জ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে (ওসি) এফআইআর হিসেবে গ্রহণের আদেশ দিয়েছেন। মামলার আরজিতে শেখ হাসিনা, শেখ রেহানাসহ ৯ জনকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে।
অন্য আসামিরা হলেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর তথ্যসচিব নাঈমুল ইসলাম খান, একাত্তর টিভির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোজাম্মেল বাবু ও সাংবাদিক-উপস্থাপিকা ফারজানা রুপা, বগুড়া-২ (শিবগঞ্জ) আসনের জাতীয় পার্টির সাবেক সংসদ সদস্য শরিফুল ইসলাম (জিন্নাহ), তার ছেলে হুসাইন শরীফ, শ্যালক ও শিবগঞ্জ উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ফিরোজ আহম্মেদ, সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান শাহ নেওয়াজ (বিপুল), রেজ্জাকুল ইসলাম প্রমুখ। আরজিতে মোট ৮০ জনের নাম উলেখ করা হয়েছে। এছাড়া আরো ৬০ জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়েছে।
মামলার আরজিতে উলেখ করা হয়, ২০১৮ সালের ২৬ জানুয়ারি শিবগঞ্জ উপজেলার ময়দানহাটা ইউনিয়নের মহাবালা স্কুলমাঠে মহাজোট–সমর্থিত জাতীয় পার্টির প্রার্থী শরিফুল ইসলামের নির্বাচনী সভা হয়। ওই সভা থেকে ফেরার পথে আসামিরা মহাবালা সেতুর কাছে ময়দানহাটা ইউনিয়ন বিএনপি’র সভাপতি শাহ আলমকে অপহরণ করেন। ১ থেকে ৯ নম্বর আসামির হুকুমে এবং পরিকল্পনায় তাকে গুম করা হয়। পরে ২০১৮ সালের ২ ফেব্র“য়ারি নওগাঁর রানীনগর উপজেলা থেকে শাহ আলমের অর্ধগলিত লাশ উদ্ধার করা হয়।
শিবগঞ্জ থানার ওসি আবদুর রউফ শুক্রবার বলেন, আদালতের নির্দেশে হত্যা মামলাটি থানায় এজাহার হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে।
নারায়ণগঞ্জ : বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, ওবায়দুল কাদের, আসাদুজ্জামান খান কামালসহ ৫১ জনকে আসামি করে হত্যা মামলা করা হয়েছে। মামলায় দিপু মনি, আনিসুল হক, জুনায়েদ আহমেদ পলক, শামীম ওসমান, কাউন্সিলর শাহজালাল বাদল, মতিউর রহমান মতিকেও আসামি করা হয়েছে।
শিমরাইল এলাকায় হাফেজ সোলায়মান (১৯) গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহতের ঘটনায় তার দুলাভাই শামীম কবির বাদী হয়ে বৃহস্পতিবার (২২ আগস্ট) রাতে মামলাটি করেন। সিদ্ধিরগঞ্জ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) মোজাম্মেল হক মামলার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
মামলায় উলেখ করা হয়, গত ৫ আগস্ট দুপুর দেড়টায় সিদ্ধিরগঞ্জ চিটাগাংরোডে ডাচ বাংলা ব্যাংকের সামনে দুর্বৃত্তের গুলিতে তার শ্যালক সোলাইমান ডানপাশের রানে গুলিবিদ্ধ হয়ে রাস্তায় লুটিয়ে পড়ে। পরে পথচারীদের সহায়তায় তাকে চিকিৎসার জন্য ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে নেওয়ার পথিমধ্যে মৃত্যু হয়।