রিজেন্টে পরীক্ষা ছাড়াই ছয় হাজার করোনা রিপোর্ট!

খুলনার চিত্র ডেস্কঃ
  • প্রকাশিত : বুধবার, ৮ জুলাই, ২০২০

বেসরকারি রিজেন্ট হাসপাতালের লাইসেন্সের মেয়াদ শেষ হয়েছিল ছয় বছর আগে। এর অবকাঠামোও ঠিক হাসপাতালের মতো নয়। এতকিছুর পরও সেই হাসপাতালের সঙ্গেই করোনা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার জন্য চুক্তি করেছিল স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। বিনামূল্যে এই চিকিৎসা দেওয়ার কথা থাকলেও সাধারণ রোগীদের কাছ থেকে টাকা হাতিয়ে নিয়েছে রিজেন্ট কর্তৃপক্ষ। চুক্তি অনুযায়ী সরকারের কাছেও বিল জমা দিয়েছে প্রায় দুই কোটি টাকার।

হাসপাতালটির অপকর্মের এখানেই শেষ না। করোনা টেস্টের নামে যা করেছে, তা রীতিমতো বিস্ময়কর। করোনার উপসর্গ থাকা হাজার হাজার মানুষের কাছ থেকে বাসায় গিয়ে নমুনা সংগ্রহ করেছে প্রতিষ্ঠানটি। যদিও তাদের সেই অনুমতি ছিল না। কিন্তু সেই নমুনার কোনো ধরনের টেস্ট ছাড়াই নিজেদের অফিসের কম্পিউটারে বানিয়েছে ভুয়া রিপোর্ট। ছয় সহস্রাধিক রোগীর হাতে ধরিয়ে দেওয়া হয়েছে করোনা নিয়ে এ ধরনের ভুয়া সনদ। বিনিময়ে হাতিয়ে নিয়েছে টাকা। আবার অনেকের নমুনা সরকারি প্রতিষ্ঠানে ফ্রি টেস্ট করিয়েও হাতিয়ে নিয়েছে টাকা।

দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে গত মার্চ থেকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সঙ্গে চুক্তি করে রিজেন্ট হাসপাতালের উত্তরা আর মিরপুর শাখা থেকে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছিল। কিন্তু সোমবার থেকে গতকাল মঙ্গলবার পর্যন্ত র‌্যাবের অভিযানের পর করোনা চিকিৎসা আর টেস্টের নামে রিজেন্টের ভয়ংকর অপকর্মের তথ্য বেরিয়ে আসে। র‌্যাবের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নির্দেশে উত্তরার রিজেন্ট হাসপাতালের নামকাওয়াস্তে চিকিৎসা কার্যক্রম বন্ধ করে সেটি সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। এর আগে সেখানে ভর্তি কয়েকজন রোগীকে সরিয়ে নেওয়া হয় অন্যত্র। অভিযানের মুখে রিজেন্ট হাসপাতালের বহুল আলোচিত সমালোচিত চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ আত্মগোপনে চলে গেছেন। পালিয়েছেন হাসপাতালের কর্মীরাও। অবশ্য র‌্যাবের পক্ষ থেকে মোহাম্মদ সাহেদ ও প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক মাসুদসহ ১৭ জনের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে।

সরকারের সঙ্গে চুক্তি করেও চিকিৎসার নামে কেন এত অনিয়ম করা হয়েছে, তা জানতে রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদের মোবাইল ফোনে কল দেওয়া হলেও সেটি বন্ধ পাওয়া যায়।

গতকাল মঙ্গলবার স্বাস্থ্য অধিদপ্তর সংবাদ বিজ্ঞপ্তি দিয়ে জানায়, নানা অনিয়মের কারণে রিজেন্ট হাসপাতালের কার্যক্রম অবিলম্বে বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। তবে অনুমোদনহীন একটি হাসপাতালের সঙ্গে কীভাবে করোনা আক্রান্তদের চিকিৎসার জন্য চুক্তি করা হলো এবং চিকিৎসার বিষয়ে কোনো ধরনের নজরদারি ছিল কিনা জানতে চাইলে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. আবুল কালাম আজাদের মোবাইলে একাধিকবার ফোন করেও পাওয়া যায়নি তাকে।

করোনা নিয়ে রিজেন্ট হাসপাতালের এমন অপকর্ম সামনে আসার পর কেন এ ধরনের ভুঁইফোঁড় প্রতিষ্ঠানকে করোনা চিকিৎসার জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কীভাবে মনোনয়ন করল সেই প্রশ্ন উঠেছে। এর আগে জেকেজি নামে আরেকটি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে করোনার ভুয়া রিপোর্ট দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। পুলিশের অভিযানের পর ওই প্রতিষ্ঠানও বন্ধ করে দেওয়া হয়। জেকিজিও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অনুমতি নিয়ে করোনার টেস্ট করাচ্ছিল। মানহীন অখ্যাত এসব প্রতিষ্ঠানকে করোনার চিকিৎসা ও পরীক্ষার জন্য মনোনয়নের পেছনে বড় ধরনের অসাধু চক্রের আর্থিক বাণিজ্য ছিল কিনা, তা খতিয়ে দেখছে একাধিক সংস্থা।

র‌্যাব জানিয়েছে, সোমবার অভিযান শুরুর পর রাতেই রিজেন্ট হাসপাতাল থেকে অননুমোদিত র‌্যাপিড টেস্টিং কিট ও একটি গাড়ি জব্দ করা হয়। ওই গাড়িতে ফ্ল্যাগ স্ট্যান্ড ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্টিকার লাগানো ছিল। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোকজনের চোখে ধুলো দিতেই হাসপাতালটির মালিক মোহাম্মদ সাহেদ এ কাজ করতেন। এ ছাড়া দুটি অনুমোদনহীন ওয়াকিটকি উদ্ধার করা হয়েছে।

র‌্যাবের একজন দায়িত্বশীল কর্মকর্তা জানান, এখন পর্যন্ত ১০ হাজার ব্যক্তির করোনার টেস্ট করায় রিজেন্ট হাসপাতাল। তার মধ্যে চার হাজার ২৬৪টি বৈধ জায়গা থেকে করানো হয়েছে। ছয় হাজারের মতো করোনার রিপোর্ট দেওয়া হয়েছে কোনো বৈধ টেস্ট ছাড়াই। প্রথমবার টেস্টের জন্য জনপ্রতি সাড়ে তিন হাজার টাকা ও দ্বিতীয়বার টেস্টের জন্য এক হাজার টাকা নেওয়া হয়।

র‌্যাবের এক কর্মকর্তা জানান, প্রতারণার এ ঘটনায় নিজে বিপদে পড়তে পারেন, এটা আঁচ করতে পেরেই কর্মচারী ছাঁটাইয়ের নাটক সাজান রিজেন্ট মালিক সাহেদ। শুধু কর্মচারীদের ওপর এ অপকর্মের দায় চাপানোর চেষ্টা করেছিলেন। আবার গোপনে কর্মচারীদের এটাও বলেছেন, খুব বেশি সমস্যায় তোদের পড়তে হবে না। তবে চার মাস ধরে বেতন-ভাতা অনিয়মিত হওয়ায় কর্মচারীরা রিজেন্টের মালিক পক্ষের ওপর অসন্তুষ্ট ছিলেন। উত্তরা ও মিরপুরের রিজেন্ট হাসপাতাল অনিয়মের আখড়ায় পরিণত হচ্ছিল।

র‌্যাব-১-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফিউল্লাহ বুলবুল বলেন, ‘নানা অনিয়মের কারণে রিজেন্ট হাসপাতাল সিলগালার নির্দেশ দিয়েছেন ম্যাজিস্ট্রেট। তবে ভেতরে রোগীদের সরিয়ে সে নির্দেশনা কার্যকর করা হবে। অবশ্য মঙ্গলবার দুপুরে হাসপাতালটি সংলগ্ন রিজেন্টের কার্যালয় সিলগালা করে দেওয়া হয়েছে। কারণ ওই অফিসেই ভুয়া রিপোর্ট তৈরি হতো।’ তিনি বলেন, রিজেন্ট হাসপাতালের মালিকসহ প্রতিষ্ঠানটির সংশ্নিষ্ট কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলার সব প্রক্রিয়া শেষ হওয়ার পরই আসামিদের গ্রেপ্তারে আরও মনোযোগী হবো।

অভিযানে নেতৃত্ব দেওয়া র‌্যাবের ম্যাজিস্ট্রেট সারোয়ার আলম বলেন, ‘রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে তিন ধরনের অভিযোগ ও অপরাধের প্রমাণ তারা পেয়েছেন। প্রথমত, তারা করোনার নমুনা পরীক্ষা না করে ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করত। এ ধরনের ১৪টি অভিযোগ র‌্যাবের কাছে রয়েছে। দ্বিতীয়ত, হাসপাতালটির সঙ্গে সরকারের চুক্তি ছিল ভর্তি রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দেওয়ার। সরকার এই ব্যয় বহন করবে। কিন্তু তারা রোগীপ্রতি লক্ষাধিক টাকা বিল আদায় করেছে। পাশাপাশি রোগীদের বিনামূল্যে চিকিৎসা দিয়েছে এই মর্মে সরকারের কাছে এক কোটি ৯৬ লাখ টাকার বেশি বিল জমা দেয়। তারা কাগজপত্র ঘেঁটে দেখেছেন, রিজেন্ট হাসপাতাল এ পর্যন্ত ২০০ কভিড রোগীর চিকিৎসা দিয়েছে।

তিনি বলেন, রিজেন্ট হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের তৃতীয় অপরাধ হলো সরকারের সঙ্গে চুক্তি ছিল ভর্তি রোগীদের তারা কভিড পরীক্ষা করবে বিনামূল্যে। নমুনা পরীক্ষা করার বিনিময়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে।

সারোয়ার আলম আরও জানান, রিজেন্ট হাসপাতালের লাইসেন্স ২০১৪ সালে শেষ হয়ে যায়। এরপর আর লাইসেন্স নবায়ন করা হয়নি। র‌্যাব এমন একটি অভিযান চালাবে, তা টের পেয়েছেন রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ সাহেদ। এজন্য কয়েকদিন আগে নিজের ফেসবুকে প্রচারণা চালাতে থাকেন অন্য কেউ তার নামে এমন অপকর্ম করছে। কৌশল করে তিনি এ নিয়ে থানায় জিডিও করেন।

এদিকে রিজেন্ট হাসপাতালে অভিযানে চাঞ্চল্যকর তথ্য বের হওয়ার পর এর মালিক মোহাম্মদ সাহেদকে নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তোলপাড় শুরু হয়েছে। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তির সঙ্গে থাকা তার ছবি পোস্ট করে লোকজন প্রশ্ন তুলছে, এমন ব্যক্তি কীভাবে প্রকাশ্যে ঘুরে বেরিয়েছেন? তার মালিকানাধীন অনুমোদনহীন হাসপাতালের সঙ্গে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর কেন চুক্তি করল, তাও খতিয়ে দেখার কথা বলছেন কেউ কেউ। অনেকে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে বলেছেন, দুটি হাসপাতালের মালিক হওয়ার পরও মোহাম্মদ সাহেদ কখনও নিজের হাসপাতালে চিকিৎসা করাতেন না। তিনি দেশের প্রভাবশালীদের সঙ্গে ছবি তুলে তা ব্যবহার করে অপকর্ম করতেন। নিয়ম না থাকলেও ফ্লাগস্ট্যান্ডের গাড়ি নিয়ে ঘুরে বেড়াতেন। সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেও তাকে প্রায় দেখা যেত। টেলিভিশন টকশোতে প্রায়ই হাজির হতেন সাহেদ। সূত্র : সমকাল

সংশ্লিষ্ঠ আরও খবর