• ২রা নভেম্বর, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ , ১৭ই কার্তিক, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দারিদ্র্যের কাছে হার মানেনি ফুলঝুরি

admin
প্রকাশিত জুলাই ২২, ২০২২, ১৫:২৮ অপরাহ্ণ
দারিদ্র্যের কাছে হার মানেনি ফুলঝুরি

গাজী জাহিদুর রহমান:
বিশ্ব ঐতিহ্যের অপরুপ শোভামন্ডিত ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। দক্ষিণ-পশ্চিম উপকুলীয় অঞ্চলের সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার আইবুড়োনদীর কোলঘেঁষে অবস্থিত মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের মথুরাপুর গ্রাম। এই গ্রামের জেলেপল্লীতে বসবাস করে স্বপন সরদার ও ভারতী সরদার। ২০০৪ সালের ২০ নভেম্বর তাদের পরিবারে দি¦তীয় সন্তান হিসাবে জন্মগ্রহণ করে ফুলঝুরি সরদার। দুই ভাই ও বোনের মধ্যে সে ছোট। তার বাবা সুন্দরবনের নদীতে মাছ ধরে ও মা গৃহিনী। ২০১৮ সালে ৭ম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হওয়ার পর আর পড়া লেখাপড়ার সৌভাগ্য তার হয়নি ফুলঝুরি সরদারের।
বাবা-মায়ের অভাব অনটনের সংসারের মধ্যে পড়ালেখা করতে না পেরে বাবার কাকড়া ও মাছ ধরা পেশায় সহযোগিতা করতো ফুলঝুরি সরদার। দৈনিক ৫০-১০০ টাকা করে আয় করত সে। এক পর্যায়ে সে জানতে পারে উত্তরণ মথুরাপুর গ্রামে মাছ ও কাকড়া শিল্পের মতো ঝুঁকিপূর্ণ কাজের সাথে জড়িত শিশুদেরকে নিয়ে একটি লার্নিং সেন্টার শুরু হতে যাচ্ছে। এ সময় ভুলে যাওয়া পড়ালেখাকে পুনরায় ধরে রাখতে আগ্রহী হয়ে ওঠে ফুলঝুরি। ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ৪র্থ শ্রেণির ছাত্রী হিসাবে অর্ন্তভূক্ত হয়ে সে নিয়মিত পড়ালেখা চলমান রাখে। লার্নিং সেন্টারে পড়ালেখার পাশাপাশি দর্জি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। ফুলঝুরি সরদারের বাবার মাত্র ৩ শতক খাস জমিতে মাটির বেড়া ও কাঁচা দেয়ালের ঘর। বাবার আর্থিক সহযোগিতা, নিজের পায়ে দাঁড়ানো এবং দর্জি পেশার কাজকে ধরে রাখার জন্য নব উদ্যমে কাজ শুরু করে সে। এতে দৈনিক ১০০ থেকে ১২০ টাকা আয় হয়।
এক সময়ে পেটে ভাত কিংবা পরোনের ন্যূনতম চাহিদামতো কাপড় ঠিকমতো জুটত না, তবুও সে দমেনি। হার মানেনি দারিদ্র্যের কাছে। নির্মম বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে ভবিষ্যৎ গড়ার পথে হাঁটছে। যথাযথ শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে দারিদ্র্য দূর করে পরিবারের দুঃখী বাবা-মার মুখে হাসি ফোটানোই তার মূল লক্ষ্য। এজন্য লেখাপড়ার পাশাপাশি দর্জির কাজ করে সার্থক হয়েছে। স্বপ্নপূরণের দিকে এগিয়ে চলছে ফুলঝুরি। জীবনযুদ্ধে নেমে শত বাধা পেরিয়ে সে দেখিয়েছে বিশেষ কৃতিত্ব।
ফুলঝুরি সরদার জানায়, সে লেখাপড়ার পাশাপাশি টেইলার্সে কাজ করবে। ভালভাবে কাজ শিখে সে সফল নারী দর্জি হয়ে নিজেই টেইলার্সের মালিক হবে। বাবা-মায়ের সংসারের কষ্ট দূর করবে। যতদিন নিজে একটি দোকান করতে না পারবে ততদিন এভাবেই কাজ করে যাবে। নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে চায় সে।
মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়নের মথুরাপুর গ্রামে উত্তরণের শিশু শিক্ষাকেন্দ্রের কয়েকজন শিক্ষার্থী জানায়, শিশু শিক্ষাকেন্দ্রে পড়তে তাদের ভালো লাগে। কারণ আগে তারা স্কুলে যেতে পারতো না। বর্তমানে কাজের পাশাপাশি তারা এখানে পড়াশুনার সুযোগ পেয়েছে। এরমধ্যে অনেকেই ইন্ডাষ্ট্রিয়াল সুইং মেশিন, টেইলরিং, ইলেকট্রনিকস ও মোবাইল সার্ভিসিংয়ের বিষয়ে তিন মাসের কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে।
উত্তরণের এডুকো প্রকল্পের প্রকল্প ব্যবস্থাপক নাজমা আক্তার বলেন, শ্যামনগর উপজেলায় মুন্সিগঞ্জ, বুড়িগোয়ালিনি, গাবুরা ও কাশিমাড়ী ইউনিয়নে এই প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই চার টি ইউনিয়নের চারটি লার্নিং সেন্টারে ৩৫০ জন শ্রমজীবী শিশুকে শিক্ষাদান কার্যক্রম চলমান রয়েছে। এই শিশুরা নিয়মিত লার্নিং সেন্টারে এসে লেখাপড়া করছে এবং এরমধ্য থেকে ২৫ জন ইন্ডাষ্ট্রিয়াল সুইং মেশিন ও টেইলরিং এবং ২৫ জন ইলেকট্রনিকস ও মোবাইল সার্ভিসিংয়ের বিষয়ে তিন মাসের কারিগরি প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছে। এছাড়া এই সকল শ্রমজীবী শিশুদের শিক্ষার প্রতি আগ্রহ ও সুযোগ বৃদ্ধির জন্য শিশুদেরকে নিয়ে বিভিন্ন ধরণের কর্মসূচির আয়োজন করা হয়।
মথুরাপুর শিশু শিক্ষাকেন্দ্রের সভাপতি মিসেস নুরজাহান খাতুন বলেন, ঝুঁকিপূর্ণ পেশায় নিয়োজিত ঝরেপড়া শিক্ষাবিমুখ শিশুদের কাছে এখন আদর্শ শিক্ষার বিদ্যাপীঠ হিসেবে পরিচিতি অর্জন করেছে শিশুকেন্দ্রটি। এখানে পড়াশুনার মান খুবই ভালো। আগে এখানকার শিশুরা স্কুলে যেতে পারতো না। এখন নিয়মিত স্কুল করার পাশাপাশি তারা অবসর সময়ে মা-বাবার সাথে মাছ ও কাঁকড়া ধরে আয় করে থাকে।
মুন্সীগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান অসীম কুমার মৃধা বলেন, উত্তরণের এডুকো প্রকল্পের এই কার্যক্রম উপকূলীয় এলাকায় ঝুঁকিপূর্ণ কাজে নিয়োজিত শিশুদের মাঝে শিক্ষার আলো ছড়াচ্ছে।
শ্যামনগর উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তা মোঃ সোহাগ হোসেন জানান, মূলত ঝুঁকিপূর্ণ শিশুশ্রমে নিয়োজিত স্কুল বহির্ভূত শিশুদের শিক্ষার মূল স্রোতে আনার জন্যই এ ব্যবস্থা। এটি দুর্গম ও পিছিয়ে পড়া উপকূলীয় এলাকায় অত্যন্ত কার্যকর ভূমিকা রাখছে। বিশেষ করে ইলেকট্রনিকস ও মোবাইল সার্ভিসিং এবং সুইং মেশিন ও টেইলরিং প্রশিক্ষণ একটি সময়োপযোগী পদক্ষেপ বল মনে করেন তিনি।